জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীদের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার দৌড়ঝাঁপ বেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। সিআইবি রিপোর্টে খেলাপি থাকলে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। ঋণ সংক্রান্ত এ তথ্য তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ।
ঋণখেলাপির দায় এড়াতে আদালত থেকে স্টে অর্ডার এনে অস্থায়ী স্বস্তি নিচ্ছেন অনেকে। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন চাইলে আর্থিকভাবে দায়মুক্ত ব্যক্তিরাই প্রার্থী হওয়া উচিত বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নির্বাচনের আগে এই চাপ সামাল দিতে তারা কঠোর মনিটরিং শুরু করেছে। ব্যাংকগুলোর পাঠানো ঋণতথ্য একটিও ভুল হলে তার দায় সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আসবে—এ বিষয়ে তাদের কড়া সতর্কতা দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাজনীতিবিদদের ভিড়
নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বাংলাদেশ ব্যাংকে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের উপস্থিতি বাড়ছে। অনেকেই খেলাপি অবস্থা পরিবর্তনের অনুরোধ করছেন, আবার কেউ আদালতের স্টে অর্ডার নিয়ে এসে সাময়িকভাবে নিজেদের ‘নিয়মিত ঋণগ্রহীতা’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। তবে তারা সরাসরি রাজনীতিবিদ পরিচয়ে নয়—ব্যবসায়ী পরিচয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকে আসছেন। কারণ প্রার্থী হওয়া ছাড়াও তাদের ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত।
স্টে অর্ডার মানে খেলাপি থেকে বাঁচা নয়। রায় বদলালে আবার খেলাপি হবেন। ব্যাংক প্রভিশনও কমাতে পারে না। কেউ যদি মনে করেন কোর্টের আদেশে টাকা না দিয়েই পার পাওয়া যাবে- এটা ভুল ধারণা।- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার কঠোর অবস্থানে থাকায় আগের মতো সুবিধা করা বা তথ্য বদলানোর সুযোগ পাচ্ছেন না নেতারা। ব্যাংকের কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে কাঙ্ক্ষিত অনৈতিক সুবিধা আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আদালতের অস্থায়ী আদেশেই মুক্তি
প্রকৃত ঋণখেলাপিরা আদালত থেকে সাময়িক স্থগিতাদেশ (স্টে অর্ডার) পেলেও ব্যাংকগুলো তাদের এখনো খেলাপি হিসেবেই গণ্য করে। তবে নির্বাচনি বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এসব অস্থায়ী আদেশকেই গুরুত্ব দেয়। ফলে আদালতের স্টে যেন হয়ে ওঠে তাদের ‘মুক্তির চাবিকাঠি’, যার সুযোগ নিয়ে অনেক খেলাপি ঋণধারীও নির্বিঘ্নে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, কারও নামে খেলাপিঋণ থাকলে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে অবশ্যই সেই ঋণ পরিশোধ বা নবায়ন করতে হয়। সময়মতো নবায়ন সম্পন্ন হলে প্রার্থিতা বাতিলের ঝুঁকি থাকে না। এতে আইনগত ধারা কঠোর হলেও স্টে অর্ডারের সুযোগ কেন্দ্র করে বাস্তবে খেলাপি ঋণধারীরাও নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় বৈধভাবে জায়গা করে নিতে পারছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত তিন-চার মাসে এ ধরনের রিট বা স্টের সংখ্যা ২৫০–৩০০’র মতো হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিনই ১০ থেকে ২০টি পর্যন্ত স্টে অর্ডার নিয়ে আসছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। কোনো কোনো স্টে অর্ডারে সরাসরি সিআইবি থেকে নাম ব্লক করে দেওয়ার কথাও উল্লেখ থাকে। কোনো অর্ডারে আবার এক মাস থেকে ছয় মাসের জন্য স্টে করা থাকে। আদালতের রায়ের ওপর ব্যাংকের আসলে কিছুই করার থাকে না। তবে ব্যাংক চেষ্টা করে আইন বিভাগের মাধ্যমে সমাধান বা আইনি পদক্ষেপের। একইভাবে ব্যাংকগুলোকেও বলা হয় আইনি পদক্ষেপ নিতে।
প্রার্থীদের ঋণতথ্য প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন চাইলে আর্থিকভাবে দায়মুক্ত ব্যক্তিরাই প্রার্থী হওয়া উচিত। স্টে অর্ডারকে ঢাল বানিয়ে খেলাপি লুকানো বন্ধ করতে হবে।–অর্থনীতিবিদ হেলাল আহমেদ জনি
সিআইবি বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আদালত নির্দেশ দিলে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে স্ট্যান্ডার্ড দেখাতে বাধ্য। ব্যাংকগুলোর বার্ষিক রিপোর্টের মন্তব্য কলামে লিখতে হয়, ‘রিটের কারণে স্ট্যান্ডার্ড।’ এতে বড় ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত আর্থিক অবস্থাও আড়ালে পড়ে যায়।
তফসিলের আগে শেষ প্রস্তুতি
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তফসিল ঘোষণার কমপক্ষে সাতদিন আগে প্রার্থীদের সিআইবি রিপোর্ট একেবারে ক্লিন থাকতে হবে। সেজন্য ব্যাংকগুলোকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তথ্য যাচাই ও হালনাগাদ রাখতে বলা হয়েছে। আমরা চাই নির্বাচন হোক স্বচ্ছ ও নৈতিক। তাই ভুল তথ্যের কোনো সুযোগ নেই।
ব্যাংকগুলোর জন্য কঠোর নির্দেশনা
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে- ঋণতথ্য আপলোডে কোনো ভুল, গাফিলতি বা তথ্য বিকৃতির ঘটনা বরদাশত করা হবে না। সঠিক তথ্য আপলোডে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং প্রয়োজন হলে চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. আনিসুর রহমান সম্প্রতি সব তফসিলি ব্যাংককে স্পষ্ট নোটিশ দিয়েছেন। এতে বলা হয় ‘গ্রাহকের ঋণ তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও আপলোড করতে হবে। তথ্য যেন কোনোভাবেই বিকৃত বা ভুল না হয়।’
গত ২৯ অক্টোবর ও ৩ নভেম্বর দুই দফায় মোট ৯৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ডেকে নির্বাচনের আগে সিআইবি তথ্য হালনাগাদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বিশেষ করে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, তাদের তথ্য শতভাগ নির্ভুল রাখতে হবে। ভুল পাওয়া গেলে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।
আইন কী বলছে
আরপিওর (নির্বাচনি আইন) ১২(১)(১) ধারায় স্পষ্ট; নমিনেশন দেওয়ার আগে ঋণ বা কিস্তি পরিশোধ না করলে প্রার্থিতা বাতিল হবে। সিআইবি (Credit Information Bureau) ক্লিয়ারেন্স হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি রিপোর্ট, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের ইতিহাস ও খেলাপি তথ্য থাকে। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ অনুমোদনের আগে এই রিপোর্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ঋণখেলাপি প্রার্থী হতে পারেন না।
২০২৪ সালের নির্বাচনে সিআইবি তথ্য অবৈধভাবে পরিবর্তনের ঘটনা সামনে এসেছিল। প্রায় ১৪শ জনের রিপোর্ট পরিবর্তন করা হয়। পরে ওই বিভাগের পরিচালককেও সরিয়ে দেওয়া হয়। এবার তাই বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সতর্ক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এসব বিষয় কীভাবে বিবেচনা করবে, তা আমাদের জানা নেই। আদালত কোনো খেলাপি ঋণ বিষয়ে রায় স্থগিত রাখলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিতে তারা খেলাপিই থাকেন। প্রার্থিতা বাতিল হবে কি না এটাই নির্ধারণের একমাত্র ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় ব্যাংকগুলোকে বলি টিকে থাকার একমাত্র উপায় হলো ঋণ আদায়। খেলাপিরা যদি নিয়মিত রি-শিডিউল না করে কেবল স্থগিতাদেশের মাধ্যমে রেহাই পেতে থাকে এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে সেটিই ব্যাংকের প্রকৃত ব্যর্থতা।’
মুখপাত্র বলেন, ‘প্রতিদিন ১৫-২০ জন প্রার্থী আদালতের স্টে অর্ডার নিয়ে আসছেন। অনেক ক্ষেত্রে আদালত নির্দেশ দেন ‘খেলাপি বলা যাবে না।’ অথবা ‘সিআইবি তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে হবে।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব নির্দেশ অমান্য করতে পারে না। তাই সিআইবিতে লিখতে হয় ‘কোর্টের নির্দেশনায় আনক্লাসিফায়েড/স্ট্যান্ডার্ড।’
তবে তিনি সতর্ক করে দেন, ‘স্টে অর্ডার মানে খেলাপি থেকে বাঁচা নয়। রায় বদলালে আবার খেলাপি হবেন। ব্যাংক প্রভিশনও কমাতে পারে না। কেউ যদি মনে করেন কোর্টের আদেশে টাকা না দিয়েই পার পাওয়া যাবে- এটা ভুল ধারণা।’
ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক ও দুর্বলতা
অনেক ব্যাংক নিজেরাই সময়মতো পদক্ষেপ নেয় না। সদিচ্ছার ঘাটতি, দুর্বল মামলা পরিচালনা ও পুনর্গঠনে সুযোগ না দেওয়ায় অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। এ বিষয়ে আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘গ্রাহক ইচ্ছুক হলে নিয়মিত যোগাযোগ, ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে সহায়তা করতে হবে। আর ইচ্ছুক না হলে ব্যাংককেও আইনি লড়াই করতে হবে। নির্বাচন কমিশন চাইলে স্টে–প্রাপ্তদেরও খেলাপি হিসেবে গণ্য করতে পারে। এটি তাদের একক এখতিয়ার।’
অর্থনীতিতে চাপ বাড়ার আশঙ্কা
উচ্চ আদালতের কিছু আদেশ ব্যাংকখাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এক–তৃতীয়াংশ ঋণ যদি খেলাপি হয়, তবে সুদের হার ৩০ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু ব্যাংকগুলো ১৩–১৪ শতাংশ হারে টিকে আছে। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়লে অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে- জানান আরিফ হোসেন খান।
খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য গোপন থাকলে ব্যাংকখাতের স্থিতিশীলতা মূল্যায়নে স্বচ্ছতা নষ্ট হয়। এতে নীতিনির্ধারণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত- সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক দিক তৈরি হয় বলে জানান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ হেলাল আহমেদ জনি।
হেলাল আহমেদ জনি মনে করেন, ‘প্রার্থীদের ঋণতথ্য প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন চাইলে আর্থিকভাবে দায়মুক্ত ব্যক্তিরাই প্রার্থী হওয়া উচিত। স্টে অর্ডারকে ঢাল বানিয়ে খেলাপি লুকানো বন্ধ করতে হবে।’
প্রযুক্তি সহায়তায়: Star Web Host It